বন্ধু,পরিবার-পরিজনদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে বেরিয়েছি। “আহা! কি অপরূপ প্রকৃতির এই নির্মল দৃশ্য। ইশ! যদি এই ভ্রমণ স্মৃতিকে ফ্রেম বন্ধি করে রাখা যেতো। “
হ্যা! সুদূর অতীতে মানুষের মনে এমন আকাঙ্ক্ষা জেগেছে বহুবার। কিন্তু, বর্তমান সময়ে নিজের ভাললাগা গুলো ফ্রেম বন্ধি করে সেই স্মৃতি সংরক্ষণ করাটা কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান মাত্র। আজ মানুষ চাইলেই তার হাতে থাকা ওই ‘ক্যামেরা’-টি দিয়ে ধারণ করতে পারে তার প্রীয়জনদের সাথে কাটানো বিশেষ মুহুর্তগুলো, স্মৃতিচারণে জমিয়ে রাখতে পারে ঘুরে আশা প্রকৃতির ওই আমায়িক দৃশ্যগুলো, সংরক্ষণ করে রাখতে পারে ঐতিহাসিক যেকোনো নিদর্শণ।
আচ্ছা, যে বস্তুটি আমাদের মুহুর্তগুলোকে বাচিয়ে রাখতে ব্যাপক ভুমিকা রেখে চলেছে, মনে কি প্রশ্ন জাগেনা, “কখন-কিভাবে এলো এই আশ্চর্যিত বস্তুটি? কে-ই বা ঘাটালো এর উদ্ভাবন! ”
আসুন তাহলে এক নজরে জেনে নেই বিষ্ময়কে বিষ্মিত করা ‘ক্যামেরা’ নামক বস্তুটির আবির্ভাব ঘটার ইতিহাস সম্পর্কে।
বলছি ১০০০ সালের পূর্বের কথা। সেকালে মানুষ তাদের পছন্দনীয় বিষয়-বস্তু, ইমারতের প্রতিফলক সংরক্ষণ করতে নানাবিধ উপায় অবলম্বল করতেন। কখনো তারা পাথরের উপর চিত্র অঙ্কণ করেছেন, কখনো কাঠ দিয়ে ফলক তৈরি করেছেন। একটা সময় রঙ -তুলির প্রচলন শুরু হলে কাপড়ে-কাগজে, পাথরে ছবি আঁকা শুরু হয়। স্মৃতি রক্ষার্থে মানুষের ছবি, ইতিহাসখ্যাত ইমারত, ঐতিহাসিক বিভিন্ন দৃশ্য ও শখের বস্তুকে কলম অথবা রঙ-তুলির সাহায্যে ক্যানভাসে ধরে রাখবার চেস্টা করেছেন।
এরপর মানুষ ভাবতে থাকে বিভিন্ন উপায়, যেনো এই চিত্র কর্মকে আধুনিক রুপ দেয়া যায়। অর্থাৎ, কিভাবে খুব সহজেই নিখুঁতভাবে ছবি ধারণ করা সম্ভব। চলতে থাকে গবেষণা। আবিষ্কৃত হয় ছবি তোলার বিভিন্ন কেমিক্যাল।
সময়টি ১০২১ সাল। ইবন-আল-হাইতাম নামক এক ইরাকি বিজ্ঞানী আলোক বিজ্ঞানের ওপর ‘কিতাব আল-মানাজির’ নামে আরবি ভাষায় সাত খণ্ডের একটি বই রচণা করেন। মূলত, সেখান থেকেই ক্যামেরা উদ্ভাবনের প্রথম সূত্রপাত।
এরপর দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে ১৫’শ শতাব্দীতে একদল চিত্রশীল্পি তাদের অঙ্কিত চিত্রগুলোর একাধিক অনুলীপি বা কপি তৈরির করার জন্য ক্যামেরা তৈরির প্রচেষ্টা চালায়। যা ইতিহাসে ক্যামেরা তৈরির প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ক্ষ্যাত। যার ধারাবাহিকতায় ১৫৫০ সালে জার্মান বিজ্ঞানি ‘জিরোলামো কারদানো’ যিনি প্রথমবারের মত ক্যামেরাতে লেন্স সংযোজন করেন। কিন্তু ক্যামেরায় ওই লেন্স দিয়ে তখনও কোনো ছবি তোলা সম্ভব ছিলো না। শুধু ছবিই আঁকা যেত।
সালটি ছিলো ১৮২৬, ক্যামেরার ইতিহাসে একটি টার্নিংপয়েন্ট। ‘জোসেপ নাইসপোর নিপস’ প্রথমবারের মতো আলোকচিত্র ধারণের উপায় উদঘাটন করেন। তিনি পাতলা কাঠের বাক্সের মধ্যে বিটুমিন প্লেটে আলোর ব্যবহার করে ক্যামেরার কাজটি করেছিলেন। এ কারনে তাকে প্রথম ক্যামেরা আবিষ্কারক হিসেবে বিচনা করা হয়।
পরবর্তী সময়ে তার ক্যামেরা সংক্রান্ত সেই তত্ব বা ধারণার ওপর ভিত্তি করে ‘ফ্রাঞ্চমেন চার্লেস’ এবং ‘ভিনসেন্ট ক্যাভেলিয়ার’ নামক দুই ব্যাক্তি প্রথমবারের মত আবিষ্কার করেছিলেন একটি সফল ক্যামেরা।
এরপর কালের ধারাবাহিকতায় ক্যামেরার চিত্র ধারণ পদ্ধতিতে আসে নতুন থেকে নতুনত্ব।
১৮৪০ সালে বিজ্ঞানী উইলিয়াম টালবোট স্থায়ী চিত্র ধারণের জন্য ছবিকে নেগেটিভ ইমেজ থেকে পজিটিভ ইমেজে পরিবর্তন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এরপরই বিশ্বব্যাপী দ্রুতবেগে সম্প্রসারিত হতে থাকে ক্যামেরাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ।
‘জর্জ ইস্টম্যান’ ১৮৮৫ সালে প্রথমবার তার ক্যামেরা ‘কোডাক’-এর জন্য উৎপাদন করেন ‘পেপার ফিল্ম’। ‘কোডাক’ ছিলো বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য তৈরি প্রথম ক্যামেরা। এর ঠিক এক বছর পরেই পেপার ফিল্মের পরিবর্তে স্থান নেয় ‘সেলুলয়েড ফিল্ম’।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। উদ্ভাবিত হয় একটুর চেয়ে আরো একটু আধুনিক ক্যামেরা।
সাল ১৯৪৮, আবিষ্কৃত হয় প্রথম ‘পোলারয়েড ক্যামেরা’। যার মাধ্যমে মাত্র এক মিনিটেই ছবিকে নেগেটিভ ইমেজ থেকে পজিটিভ ইমেজে রূপান্তর করা সম্ভব ছিল। যা ক্যামেরার ইতিহাসে যুক্ত করে যুগান্তকারী পরিবর্তন।
দীর্ঘ প্রায় ৭৫ বছরে অ্যানালগ ক্যামেরার ব্যবহার সারা বিশ্বে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এরপর ১৯৭৫ সালে উঠে আসে একটি নাম ‘স্টিভেন স্যাসন’, যিনি ক্যামেরার সকল ইতিহাসকে পেরিয়ে বর্তমান আধুনিক ক্যামেরার নতুন এক প্রজন্মের সৃষ্টি ঘটিয়েছেন। কোডাকের স্টিভেন স্যাসোন প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরার উদ্ভাবন করেন।
তারই ধারাবাহিকতায় কালের বিবর্তনে আজ ক্যামেরা মানুষের হাতের মুঠোয়।
তো, এই ছিলো আমাদের আনন্দের, সুখের মুহুর্তগুলোকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে সহযোগী আমাদের হাতে থাকা ‘ক্যামেরা’র ইতিহাস। যা আজ আধুনিকতার ছোঁয়ায় এতটাই আধুনিক যে, আমাদের নিত্যদিনে ব্যবহারিক স্মার্টফোনের অংশ হিসেবে দৈনিক জীবনের যেকনো সময় যেকোনো মূহুর্ত ফ্রেম বন্ধি করে রাখতে সক্ষম।